নিলামে তুলেও এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি বিক্রি করতে পরছে না ব্যাংকগুলো

Date:

Share post:

ঢাকা: এস আলম গ্রুপের বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির জন্য বারবার নিলাম ডেকেও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঋণ আদায়ে এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই অর্থ ঋণ আদালতে মামলা দায়েরের পথে হাঁটছে ব্যাংকগুলো। এতে ঋণের টাকা উদ্ধারের পুরো প্রক্রিয়াটি আরও দীর্ঘায়িত হয়ে উঠছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নেওয়া হাজারো কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় দেশের ব্যাংকগুলো বড় ধরনের আর্থিক চাপে পড়েছে। এমনকি, নিলামে তুলেও গ্রুপটির বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ফলে বারবার নিলাম ডেকে ব্যর্থ হয়ে ঋণ আদায়ে এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই অর্থ ঋণ আদালতে মামলা দায়েরের পথে হাঁটছে ব্যাংকগুলো। এতে ঋণের টাকা উদ্ধারের পুরো প্রক্রিয়াটি আরও দীর্ঘায়িত হয়ে উঠছে।

উদাহরণস্বরূপ, জনতা ব্যাংকের সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখা এস আলম গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ৬ বার নিলামের আয়োজন করে। ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে দরপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও এ সময়ের মধ্যে কোনো ক্রেতা পাওয়া যায়নি, যার ফলে আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছে ব্যাংক।

জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপক বাদল কান্তি দাশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “নিলামে সাড়া না পাওয়ায় আমাদের বাধ্য হয়ে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করতে হয়েছে। অতিমূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যাংকগুলো ঋণের পরিমাণের চেয়ে কম দামেই সম্পত্তি বিক্রি করে থাকে। তবে আমরা জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও কোনো সাড়া পাইনি।”

একইভাবে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশও এস আলম গ্রুপের এক লাখ কোটি টাকার বেশি বকেয়া ঋণের বিপরীতে নিলামের আয়োজন করেও ক্রেতা পায়নি। ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখা গত মার্চ থেকে গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সাত দফা নিলাম ডেকেছে। এরমধ্যে দুটির মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হলেও কোনো দরপত্র জমা পড়েনি।

সাম্প্রতিক এক উদ্যোগে, ইসলামী ব্যাংকের চকবাজার শাখা গত ২৮ এপ্রিল এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আইডিয়াল ফ্লাওয়ার মিলসের মালিকানাধীন সীতাকুণ্ডের বানশবাড়িয়ার একটি জমি নিলামে তুলেছে। ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে এই নিলাম ডাকা হয়। আগ্রহী ক্রেতাদের আগামী ৮ মের মধ্যে দরপত্র জমা দিতে হবে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ইসলামী ব্যাংক থেকে আইডিয়াল ফ্লাওয়ার মিলস ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়, যা সুদসহ বেড়ে বর্তমানে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া, গত ২৭ এপ্রিল ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের একটি স্টিল মিল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ভোজ্যতেল কারখানা ও ৩৮ বিঘা জমিসহ বিভিন্ন সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। এসবের বিপরীতে গ্রুপটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।

জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে এস আলম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান—এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল লিমিটেড, এস আলম পাওয়ার জেনারেশন এবং এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের বন্ধকী সম্পত্তির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

এর আগে, গত ২২ এপ্রিল এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের সম্পত্তিরও নিলাম আহ্বান করেছিল ব্যাংকটি। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম (মাসুদ) এবং তার ভাই মোহাম্মদ আবদুল্লাহ হাসান হলেন চেয়ারম্যান।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মূলত মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই নিলাম ডাকা হচ্ছে। মার্চ ও এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত দুটি নিলামে কোনো দরপত্র জমা পড়েনি।

তারা বলেন, “সত্যি কথা বলতে, আসন্ন নিলামগুলোতেও আগ্রহী ক্রেতা পাওয়া যাবে বলে আমরা আশাবাদী নই, কারণ অনেকেই ভয় পাচ্ছেন।”

তবে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে নিলাম প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংকগুলো।

৫ আগস্টের পর থেকে এস আলম গ্রুপের বন্ধকী সম্পত্তি পর্যায়ক্রমে নিলামে তুলছে ইসলামী ব্যাংক। জানা গেছে, গ্রুপটির মালিক বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৮৩ শতাংশ শেয়ার দখল করে রেখেছিল। সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় এসব শেয়ার জব্দ করা হয় এবং ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এরমধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠানটির ওপর থেকে শেষ হয় এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ।

অভিযোগ রয়েছে, এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বড় একটি অংশ পাচার করা হয়েছে বিদেশে। এরমধ্যে সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা এবং পরোক্ষভাবে নেওয়া ঋণ ২০ হাজার ৩৮ কোটি টাকা।

এদিকে, এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী কোম্পানিগুলোসহ বড় ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ মোকাবিলায় ১৪ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় লিগ্যাল টিম গঠন করেছে ইসলামী ব্যাংক। সম্প্রতি ব্যাংকের অডিট কমিটির বৈঠকে এ টিমের অনুমোদন দেওয়া হয়। এই টিম ব্যাংককে আইনি সহায়তা, অভিযোগের খসড়া প্রস্তুত, নোটিশ পর্যালোচনা এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ে মামলা পরিচালনায় সহায়তা করবে।

এছাড়া এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে জব্দ করা শেয়ারগুলো বিক্রির সম্ভাবনা নিয়ে আইডিবি, আইএফসি, বিশ্বব্যাংক ও আল-রাজহি গ্রুপের মতো আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেছে ইসলামী ব্যাংক। তবে এর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্র জানায়, এস আলম গ্রুপের সরাসরি বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা আটটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বর্তমানে বড় অংকের ঋণ খেলাপির বোঝা বহন করছে। এসব ব্যাংকও গ্রুপটির বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

spot_imgspot_img

Related articles